সাইবেরিয়া..পৃথিবীর শীতলতম এই স্থানটি মুলত রাশিয়ার একটি ভৌগলিক অঞ্চল। অনেকেই সাইবেরিয়াকে দেশ মনে করে ভুল করে থাকেন। তবে প্রকৃত সত্য হচ্ছে সাইবেরিয়ার বিশালতা এতই বড় যে এটি নর্দান এশিয়া ও ইউরেশিয়া এই দুই মহাদেশীয় সীমানা নিয়ে গঠিত। তবে আজকের এই সাইবেরিয়া বর্তমান রাশিয়ার ৮ম রাজ্য। ওয়েস্টার্ন সাইবেরিয়া এবং ইস্টার্ন সাইবেরিয়া এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে পুরো সাইবেরিয়াকে। রাশিয়ার আয়তনের প্রায় ৭৭% ভাগ জুড়েই আছে এই বিশালকার সাইবেরিয়ান অঞ্চল। সুবিশাল এ অঞ্চলের আয়াতন ১কোটি ৩১ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। যদি সাইবেরিয়া কোন দেশ হত তবে এটি হতে পারত পৃথিবীর বৃহৎ দেশের একটি।
সাইবেরিয়ার বয়স আড়াই কোটি বছরের ও বেশি । ভুতাত্ত্বিক দের মতে সাইবেরিয়ার অগ্নেয়গিরি গুলো ৫০ কোটি বছরের পুরোনো। প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে সাইবেরিয়ায় তিন প্রজাতির মানুষ বসবাস করত। সর্বশেষ প্রজাতির মানুষ চিহ্নিত হয় ২০১০ সালে।
১৭০০ শতাব্দীর দিকে রাশিয়ান সম্প্রদায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ন্ত্রনের জন্য বসতি স্থাপন শুরু করে। ১৮০১ সাল থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত অর্ধ মিলিয়ন ইউরোপিয়ান ও রাশিয়ান লোক পারি জমান সাইবেরিয়ায়। এ সময় শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে। তবে ১৮০০ শতাব্দির শেষ দিকে সাইবেরিয়ায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটে। ১৮৯১-১৯১৬ সালে নিমির্ত হয় ট্রেন্স সাইবেরিয়ান রেলপথ। যার মাধ্যমে আধুনিক সাইবেরিয়ার জন্ম হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য ১৯৩০-১৯৪০ পর্যন্ত সাইবেরিয়ায় বেশ কিছু কারাগার ও শ্রমশিবির নির্মান করে । এসব কারাগার ও শ্রমশিবির এ বেশিরভাগ বন্দি ছিল অরিজিনাল সাইবেরিয়ান। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত সরকার পতনের পর এগুলো প্রকাশ্যে আসে। সাইবেরিয়ার প্রধান শিল্প নগরীগুলো এসব বন্দিরাই নির্মান করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি শহর হল নরিলস্ক ও মাগাডান । সাইবেরিয়ার বড় বড় রাস্তাগুলো এসব বন্দী শ্রমিকরাই নির্মান করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় ৬ লক্ষ শ্রমিক খাদ্যের অভাবে মৃত্যুবরন করে।
সাইবেরিয়া তীব্র শীতের দেশ হলেও সারা বছরে আবহাওয়া এমন থাকে না, এমন নাটকীয় আবহাওয়ার কারন হল এখানকার মহাদেশীয় জলবায়ু। গড় তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। গড়ে জানুয়ারীতে এর তাপমাত্র রেকর্ড করা হয়েছে -১৭ ডিগী সেলসিয়াস আর গড়ে জুলাইয়ে এর তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে +২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস।তবে শীতকালে এর তাপমাত্রা -৭০ ডিগ্রীতেও পৌছায় আর গ্রীস্মকালে এর তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ফুটবল আর বাস্কেটবল এ অঞ্চলের জনপ্রিয় খেলা । এছাড়াও বান্ডি ও সাইবেরিয়ার জনপ্রিয় একটি খেলা। সাইবেরিয়ার প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠী হল রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চ। এছাড়াও এখানে খ্রিস্টধর্মের অন্যান্য বর্ণ, তিব্বতি বৌদ্ধ এবং ইসলাম সহ বিভিন্ন ধর্মের বিশ্বাসী রয়েছে।
সাইবেরিয়ার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে লেক বৈকাল সবচেয়ে জনপ্রিয়। সারা পৃথিবী থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থী ভীর করে এই লেক বৈকাল দেখার উদ্দেশ্যে। চারদিকে সবুজের সমারহ তারই মাঝখানে সচ্ছ নীল জলের লেক বৈকালের অপরূপ সৌন্দায্য, যা পর্যটকদের মোহিত করে আর এ কারনেই লেক বৈকালকে সাইবেরিয়ার নীল নয়ন বলা হয়। কেউ কেউ এর রূপে মুগ্ধ হয়ে সাইবেরিয়ার মুক্তা বলেও আখ্যা দিয়েছে। এই লেক রূপ পরিবর্তন করে ঋতু ভেদে। গ্রীস্মকালের সচ্ছ নীল জলের লেক বৈকালের পানি, শীতে পরিনত হয় বরফে। তখন চাইলে বরফের উপর দিয়ে হেটে বেড়ানো যায়। এমনকি লেকের পানি সচ্ছ হওয়ায় ৪০ মিটার পর্যন্ত গভিরে স্পস্ট দেখা যায়। সচ্ছ জলের লেক বৈকাল পৃথিবীর বৃহৎ স্বাদু পানির হ্রদ। এ হ্রদের আয়াতন ৩১৭২২ বর্গকিলোমিটার আর গভিরতা ১৬৪২ মিটার। পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর এ লেকের বয়স ২.৫০ কোটি থেকে ৩ কোটি বছর। ভূতাত্ত্বিকরা লেক বৈকাল কে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রচীনতম হ্রদ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পাহাড় দ্বারা বেস্টিত এ হ্রদে দ্বীপ রয়েছে মোট ২৭ টি। সবচেয়ে বড় দ্বীপটির নাম হল ওলখোন যার আয়াতন ৭২ কিলোমিটার, যা পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম হ্রদ-দ্বীপ। লেক বৈকালের সাথে ৩৩০ টি নদী এসে মিসেছে। প্রচীন চিনা ইতিহাসে লেক বৈকাল কে উত্তর সাগর বলে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। প্রাচীন এ লেকটি উদ্ভিদ ও প্রানী কুলের স্বর্গরাজ্য। ১৭০০ প্রজাতির উদ্ভিত ও প্রানী রয়েছে এ লেকটিতে।
সাইবেরিয়ার বেশ কিছু শহর পর্যটকদের নজর কারে, কারন বেশিরভার শহরেই সাইবেরিয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্য চমৎকার ভাবে প্রতিফলিত হয়। এছাড়াও ২০০০ কিলোমিটার উচ্চ আলটাই পর্বতের দৃশ্য মুগ্ধ করে সবাইকে । অতীত ইতিহাস আর আধুনিকতার মেলবন্ধনকে কাছ থেকে উপোভোগ করার জন্য অনেকেই আবার যাত্রা করেন ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়েতে।
এই ছিল সাইবেরিয়া নিয়ে আমাদের আজকের পর্ব।