মিশর…….. রহস্যঘেরা পিরামিড আর নীল নদের দেশ মিসর।প্রচীন কয়েকটি সভ্যতার মধ্যে মিশরীয় সভ্যতা অন্যতম।বিশ্ব সভ্যতায় সবটুক অবদান মিশরীয়দের। ধর্মীয় চিন্তা চেতনা দ্বারা উদ্ভুদ্ভ এ জাতি উদ্ভাভন করেছে অনেক কিছু। প্রচীন সভ্যতার লীলাভুমি এবং রহস্য ঘেরা দেশটির সাথে জড়িয়ে আছে কত ইতিহাস আর ঐতিয্য।
আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর-পূর্ব অংশে অবস্থিত যে দেশটি তার নামই মিশর আধুনিক যুগে যাকে বলা হয় ইজিপ্ট। প্রায় চার লক্ষ বর্গমাইল আয়তনের মিশরের রাজধানী কায়রো।তিনটি মহাদেশ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ দ্বারা পরিবেষ্টিত ভূমধ্যসাগরের উপকূলে অবস্থিত মিশর। এর উত্তরে ভূমধ্যসাগর, পূর্বে লোহিত সাগর, পশ্চিমে সাহারা মরুভূমি, দক্ষিণে সুদান ও অন্যান্য আফ্রিকার দেশ ।খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে মিশরে প্রথম সামাজ্যের উদ্ভভন ঘটে। যার একটি ছিল উত্তর মিশর (নিম্ন মিশর) অপরটি ছিল দক্ষিণ মিশর (উচ্চ মিশর)। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ৩২০০ অব্দ পর্যন্ত নীল নদের অববাহিকায় এ রাষ্ট্রের উঃপত্তি। প্রাচীন মিশকে ইতিহাসে প্রাক-রাজবংশীয় যুগ বলা হয়।প্রচীন কাল থেকেই মিশরীয় সভ্যতা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে শুরু করে।ধর্মীয় রীতি-নীতি, চিত্র-শিল্প, স্থাপত্য-ভাস্কর্য, লিখন পদ্ধতি, কাগজের আবিষ্কার, জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা সবকিছুতেই তাদের অবদান রয়েছে। ঐ সময় থেকে মিশরের ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়। একই সময়ে নিম্ন ও উচ্চ মিশরকে একত্রিত করে মিশরের প্রথম নরপতি এবং পুরোহিত নারমার বা মেনেস। তিনি প্রথম ফারাও-এর মর্যাদাও লাভ করেন। এরপর থেকে ফারাওদের অধীনে মিশর প্রাচীন বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতিতে একের পর এক উল্লেযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়।
আনুমানিক প্রায় ২৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মিশরীয় সভ্যতার বিকষিত ও প্রস্ফুটিত হয়েছিল। খ্রিষ্টাপূর্ব ৫০০০ অব্দে নব্য প্রস্তর যুগে প্রাচীন মিশরে নিরবচ্ছিন্ন ও দীর্ঘ ইতিহাসের সূচনা হয়। মিশরীয় সভ্যতার গোড়াপত্তন হয় মেনেসের হাত ধরে। খ্রিষ্টপূর্ব দশম শতকে লিবিয়ার এক বর্বর জাতি ফারাওদের সিংহাসন দখল করে নেয়। ৬৭০-৬৬২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে অ্যাসিরীয়া মিশরে আধিপত্য বিস্তার করে। ৫২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পারস্যসম্রাট সাইরাস মিশর দখল করে নিলে প্রাচীন মিশরীর সভ্যতার অবসান ঘটে।৬৪১ সালে আরব মুসলিমরা মিশরে আসলে মিশরের মানুষ দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তখন থেকেই মিশর মুসলিম ও আরব বিশ্বের একটি অংশ। আধুনিক মিশরের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী।
প্রাক-রাজবংশীয় যুগে মিশর কতগুলো ছোট ছোট নগর রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। এগুলোকে ‘নোম’ বলা হতো। মিশরের প্রথম ফারাও মেনেস বা নারমার সমগ্র মিশরকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ অব্দে ঐক্যবদ্ধ করে একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। যার রাজধানী ছিল দক্ষিণ মিশরের মেম্ফিসে। তখন থেকে মিশরে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র ও রাজবংশের উদ্ভব হয়। ‘পের-ও’ শব্দ থেকে ফারাও শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। ফ্যারাও শব্দের অর্থ হল ঈশ্বরের প্রতিনিধি। ফারাওরা ছিল অত্যন্ত ক্ষমতাশালী, রাজকার্যে সমস্ত ক্ষমতা ভোগ করতেন। তারা নিজেদেরকে সূর্য দেবতার বংশধর মনে করতেন। ফারাও পদটি ছিল বংশানুক্রমিক। পেশার উপর ভিত্তি করে মিশরীয়দের কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন- রাজপরিবার, পুরোহিত, অভিজাত, লিপিকার, ব্যবসায়ী, শিল্পী এবং কৃষক ও ভূমিদাস শ্রেণি। মিশরের অর্থনীতি মূলত ছিল কৃষিনির্ভর। উৎপাদিত ফসলের মধ্য উল্লেখযোগ্য ছিল গম, যব, তুলা, পেঁয়াজ, পিচ, খেঁজুর ইত্যাদি। খেজুর গাছকে মিশরে জীবন বৃক্ষ নামে অভিহিত করা হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যেও অগ্রগামী মিশরে উৎপাদিত গম, লিলেন কাপড় ও মাটির পাত্র ফিলিস্তিন ও সিরিয়ায় রপ্তানি করা হতো। বিভিন্ন দেশ থেকে মিশরীয়রা স্বর্ণ, রৌপ্য, হাতির দাঁত,কাঠ ইত্যাদি আমদানি করত।
আফ্রিকার ভিক্টোরিয়া হ্রদ থেকে নীলনদ উৎপত্তি লাভ করে নানা দেশ হয়ে মিশরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভূ-মধ্যসাগরে এসে মিলিত হয়েছে। ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস মিশরকে নীল নদের দান বলে অভিহিত করেছেন। নীলনদই বিশ্বের দীর্ঘতম নদ। নীলনদ না থাকলে মিশর মরুভূমিতে পরিণত হতো। প্রাচীনকালে প্রতিবছর নীলনদের কারনে মিশরে বন্যা দেখা দিত। কিছুকাল পরে বন্যার জল সরে যেতেই দুই কুল নবীন ও উর্বর পলিমাটিতে ঢাকা পড়ত। জমে থাকা উর্বর পলিমাটিতে জন্মাতো নানা ধরনের ফসল।
প্রাচীন মিশরীয়রা ধর্মীয় নিয়ম-কানুন অনুশাসন দ্বারা চরমভাবে প্রভাবিত ছিল। মানবসভ্যতার অনেক ধ্যান-ধারণা, রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠানের জন্ম প্রাচীন মিশরে। তারা জড়বস্তু, জীবজন্তু ও মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করতো। মিশরীয়দের সূর্যদেবতা ছিলেন ‘রা’ বা ‘আমন’। প্রাকৃতিক শক্তি, শস্য ও নীলনদের দেবতা ছিলেন ‘ওসিরিস’। মিশরীয়দের মতে রা এবং ওসিরিসই মিলিতভাবে জগৎ পরিচালনা করেন। তাদের জীবনে সূর্যদেবতা ‘রা’-এর গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। মিশরীয়রা মনে করত মৃত ব্যক্তি আবার একদিন বেঁচে উঠবে। সে কারণে দেহকে তাজা রাখার জন্য তারা মমি করে রাখত। এই চিন্তা থেকে মমিকে রক্ষার জন্য তারা পিরামিড তৈরি করেছিল। ফ্যারাওরা ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে দেশ শাসন করতেন। প্রধান পুরোহিত এবং অন্যান্য পুরোহিতদেরও তাঁরাই নিয়োগ করতেন।
মিশরীয়দের চিত্রকলা বিশেষভাবে বৈচিত্র্যময় ও ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। মিশরীয়রা সমাধিগৃহ আর মন্দিরের দেওয়াল সাজাতে গিয়ে চিত্রশিল্পের সূচনা করেছিল। তাদের প্রিয় রং ছিল সাদা-কালো। সমাধি, পিরামিড, মন্দির, প্রাসাদ, প্রমোদ কানন, সাধারণ ঘর-বাড়ির দেওয়ালে মিশরীয় চিত্রশিল্পীরা অসাধারণ ছবি আঁকতেন। এসব ছবির মধ্যে মিশরের রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের কাহিনী ফুটে উঠেছে।কারু শিল্পেও প্রাচীন মিশরীয় শিল্পীরা অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। আসবাবপত্র, মৃৎপাত্র, সোনা, রূপা, মূল্যবান পাথরে খচিত তৈজসপত্র, অলঙ্কার, মমির মুখোশ, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র, হাতির দাঁত ও ধাতুর দ্রব্যাদি মিশরীয় কারু শিল্পের অসাধারণ দক্ষতার প্রমান বহন করে।
প্রাচীন বিশ্বসভ্যতায় মিশরীয়দের মতো ভাস্কর্য শিল্পে অসাধারণ প্রতিভার ছাপ আর কেউ রাখতে সক্ষম হয়নি। ব্যাপকতা, বৈচিত্র্য এবং ধর্মীয় ভাবধারায় প্রভাবিত বিশাল আকারের পাথরের মূর্তিগুলো ভাস্কর্য শিল্পে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে। প্রতিটি ভাস্কর্য মানুষ অথবা জীবজন্তুর সবই ধর্মীয় ভাবধারা, আচার অনুষ্ঠান, মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। প্রতিটি শিল্পই ছিল আসলে ধর্মীয় শিল্পকলা। সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য হচ্ছে গিজার অতুলনীয় স্ফিংস। স্ফিংস হচ্ছে এমন একটি মূর্তি, যার দেহটা সিংহের মতো কিন্তু মুখ মানুষের। মিশরের সবচেয়ে বড় পিরামিডটি হচ্ছে ফ্যারাও খুফুর পিরামিড। মন্দির গুলোতে মিশরীয় ভাস্কর্য্য ও স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন প্রতিফলিত হয়েছে। মিশরের সবচেয়ে কমবয়সি ফ্যারাও হয়েছিলেন তুতেনখামেন। তুতেনখামেনের মমিটি আবিষ্কার করেছেন প্রত্নবিদ হাওয়ার্ড কার্টার। মিশরের সর্বশ্রেষ্ঠ ফ্যারাও ছিলেন দ্বিতীয় রামেসিস। তারও একটা বিশাল মূর্তি রয়েছে। মিশরের সবচেয়ে দর্শনীয় স্থানটি হল Valley of the Kings.
লিখনপদ্ধতি ও কাগজ আবিষ্কার :-
মিশরীয় সভ্যতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল লিপি বা অক্ষর আবিষ্কার। নগর সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মিশরীয় লিখনপদ্ধতির উদ্ভব ঘটে। পাঁচ হাজার বছর পূর্বে তারা সর্বপ্রথম ২৪টি ব্যঞ্জনবর্ণের বর্ণমালা আবিষ্কার করে। প্রথম দিকে ছবি এঁকে তারা মনের ভাব প্রকাশ করত। এই লিখন পদ্ধতির নাম ছিল চিত্রলিপি। মিশরের অধিবাসীদের ব্যবহৃত লিপিকে বলা হয় ‘হায়ারেগ্লিফিক’ বা পবিত্র অক্ষর। মিশরীয়রা নালখাগড়া জাতীয় গাছ থেকে কাগজ বানাতে শেখে। সেই কাগজের উপর তারা লিখত। গ্রিকরা এই কাগজের নাম দেয় প্যাপিরাস। পরবর্তীকালে এই শব্দ থেকে পেপার শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, নেপোলিয়ান বোনাপার্টের মিশর জয়ের সময় একটি পাথর আবিস্কৃত হয়, যা রসেটা স্টোন নামে পরিচিত। যাতে গ্রিক এবং ‘হায়ারেগ্লিফিক’ ভাষায় অনেককিছু লেখা ছিল, যা থেকে প্রাচীন মিশরের অনেক তথ্য জানা যায়।
বিজ্ঞান :-
মিশরীয় সভ্যতা ছিল কৃষিনির্ভর। সে কারণে নীল নদের প্লাবন, নাব্যতা, জল প্রবাহের গতিবিধি, জোয়ারভাটা ইত্যাদি ছাড়াও জমির মাপ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এসবের সঙ্গে জ্যোতিষশাস্ত্র ও গণিতশাস্ত্রের গভীর যোগাযোগ থাকায় বিদ্যা দুটি তারা আয়ত্ত করে ছিল। তারা অঙ্ক শাস্ত্রের দুটি শাখা জ্যামিতি এবং পাটিগণিতেরও জন্ম এদেশেই হয়েছিল। মিশরীয় সভ্যতার মানুষ যোগ, বিয়োগ ও ভাগের ব্যবহার জানত। খ্রিষ্টাপূর্ব ৪২০০ অব্দে তারাই পৃথিবীর প্রথম সৌরপঞ্জিকাটি আবিষ্কার করেছিল পাশাপাশি ৩৬৫ দিনে বছর গননার হিসাবটিও তাদেরই আবিষ্কার। প্রাচীন মিশরের অধিবাসীরা সময় নির্ধারণের জন্য সূর্যঘড়ি, ছায়াঘড়ি, জলঘড়ি আবিষ্কার করেছিল। তারা পরলোকে বিশ্বাস করত এবং ফারাওরা পরবর্তী জন্মেও রাজা হবেন এই বিশ্বাস তাদের ছিল। তাই তারা মৃত্যুর পরেও ফারাওদের দেহ তাজা রাখার পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেন। এই কারণেই মৃতদেহকে মমি বানানো হতো। মিশরীয় বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের প্রয়োগের মাধ্যমে মৃতদেহের পচন রধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। চিকিৎসাশাস্ত্রেও প্রাচীন মিশরীয়রা বিশেষ অগ্রগতি লাভ করেছিল। তারা চোখ, দাঁত, পেটের রোগ নির্ণয় করতে জানত। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চিকিৎসা করার বিদ্যাও তাদের জানা ছিল। তারা হাড় জোড়া লাগানো, হৃৎপিণ্ডের গতি এবং নাড়ির স্পন্দন নির্ণয় করতে পারত। মিশরীয়রা দর্শন, সাহিত্যচর্চাতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাদের রচনাশৈলিতে সর্বদা আনন্দ আর সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ দেখা গেছে।
মিশরীয় সভ্যতার বিস্ময় পিরামিড ও মমি :-
পিরামিড :- মিশরের রাজাদের বলা হত ফ্যারো বা ফ্যারাও।এটা ছিল তাদের উপাধি। মিশরের প্রজাগন তাদের ফ্যারাওদের দেবতাজ্ঞানে পুজা করত। রাজা বাদশাদের মধ্যে একটি জিনিস লক্ষ্য করা যায় যে তারা ক্ষমতায় গেলেই তাদের মধ্যে বিচিত্র খেয়ালের আবেশ ঘটে। এরকম খেয়ালের আবেশেই জন্ম হয় এক অন্যতম আশ্চর্য পিরামিডের। ২০০৮ সাল পর্যন্ত মিশরে ১৩৮টি পিরামিড আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলির অধিকাংশই নির্মিত হয় প্রাচীন ও মধ্যকালীন ফ্যারাওদের রাজত্বকালে তাঁদের ও তাঁদের পত্নীদের সমাধিসৌধ হিসেবে। মরুভুমির প্রান্তের পাহাড় থেকে পাথর কেটে এগুলো বানানো হয়। মিশরের প্রাচীনতম পিরামিডগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে মেমফিসের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত সাক্কারায়। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে পুরনোটি হল তৃতীয় রাজবংশের রাজত্বকালে নির্মিত জোসারের পিরামিড(নির্মাণকাল খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৩০-২৬১১ অব্দ)। স্থপতি ইমহোটেপ এই পিরামিড ও পিরামিড-সংলগ্ন চত্বরের নকশা প্রস্তুত করেছিলেন। সাধারণভাবে এটিকেই বিশ্বের প্রাচীনতম মসৃণ প্রস্তরনির্মিত স্মৃতিসৌধ মনে করা হয়। মিশরীয় পিরামিডগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত পিরামিডগুলি দেখা যায় কায়রো শহরের উপকণ্ঠে গিজায়। গিজায় অবস্থিত খুফুর পিরামিড মিশরীয় পিরামিডগুলির মধ্যে উচ্চতম পিরামিড। প্রাচীন বিশ্বের সাতটি আশ্চর্য বস্তুর মধ্যে অন্যতম। কেউ কেউ মনে করেন ভীনগ্রহের প্রানীরা একবার পৃথিবীতে এসেছিল এবং তাদের আগমন ঘটেছিল এই মিশরে ফলে মমি এবং পিরামিড বানানোর কৌশল মিশরীয়রা তাদের কাছ থেকে শিখে নেয়। আবার কেউ কেউ মতটির বিরোধিতা করে পিরামিডকে মনুষ্যসৃষ্ট বিস্ময় বলেই সমর্থন করেন।
মমি :- মিশরের ফ্যারাওদের ইচ্ছা ছিল তাদের নশ্বর দেহ যেন মৃত্যু পরবর্তী সময়েও অবিনশ্বর থাকে। এ ব্যাপারে তারা এক আশ্চর্য পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। যে পদ্ধতির মাধ্যমে মৃতদেহকে অনেকদিন অবিকৃত অবস্থায় রাখা যেত।একেই বলে মমি সংরক্ষণ পদ্ধতি। পিরামিডের মধ্যে মমি সংরক্ষন করা হত। মিশরীয়রা মৃত্যুর পর তাদের ফ্যারাওদের মৃতদেহকে আগুনে পোড়াত না বা স্বাভাবিক পদ্ধতিতে কবর দিতনা। তারা ভূগর্ভস্থ কক্ষে শায়িত অবস্থায় বিশেষ পদ্ধতি অনুসারে মৃতদেহকে কবর দিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মরুভূমির বুকেই মমি তৈরির মাধ্যমে মৃতদেহকে কবর দিয়ে সংরক্ষণ করত। সাধারণ মানুষের কবরের সঙ্গে বিশিষ্ট মানুষের কবরের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যেত। বিশিষ্ট ব্যক্তি অথবা ফারাওদের কবরের ওপর পাথর গেঁথে গেঁথে পিরামিড তৈরি করে স্মৃতি রক্ষা করা হত। গোড়ার দিকে মমি সংরক্ষণ পদ্ধতিতে কিছু ত্রুটি থাকার জন্য মৃতদেহ অনেকদিন অবিকৃত থাকত না তাই পরবর্তীকালে এর পদ্ধতিগত পরিবর্তন করা হয়েছিল। মানুষের মৃত্যুর পর তার দেহ থেকে পচন ধরার সম্ভাবনা আছে এরকম কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন পাকস্থলি, মস্তিষ্ক, ফুসফুস ও যকৃত প্রভৃতির অংশ বিশেষ কেটে বাদ দেওয়া হত। কেটে নেওয়া দেহের অংশ গুলোকে চারটি বিশেষ বিশেষ পাত্রে রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হত। পরে সেগুলোকে আবার মৃতদেহে রেখে দেওয়া হত। শুকনো লবণ দিয়ে মৃতদেহটিকে শুকিয়ে নেওয়া হত। পেটের কাটা অংশ সেলাই করা হত সতর্কতার সঙ্গে যাতে ভেতরে বাতাস ঢুকতে না পারে। এক গামলা পাইন গাছের বর্জ্য পদার্থ মৃতদেহের গায়ে লেপে ভালো করে ঘষে মেজে নেওয়া হত তারপর বায়ু নিরোধক লিনেন কাপড়ের চওড়া ফিতে জড়িয়ে মৃতদেহটিকে বেশ পুরু করে ফেলা হত। একটি ডালাযুক্ত কাঠের বাক্সে আপাদমস্তক মমিটিকে লিলেন কাপড় জড়িয়ে রাখা হত। তারপর শুরু হত কবর খোঁড়ার কাজ। সাধারণ কবরের চেয়ে এর আয়তন অনেক বেশি করা হত এতে অতিকায় কাঠের বাক্স সমেত মৃতদেহটিকে রাখতে অসুবিধে না হয়। মৃতদেহের সঙ্গে তার জীবৎদ্দশার প্রিয় জিনিস পত্র মমির সাথে কবরে দেওয়া হত কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল মৃত ব্যক্তির আত্মা পাখির আকৃতি ধারণ করে সারাদিন মনের সুখে এখানে-ওখানে উড়ে বেড়ায় এবং দিনের শেষে আত্মা আবার নিথর দেহে ফিরে আসে। তাই তাদের জন্য থালা, ঘটি-বাটি থেকে আসবাবপত্রাদি সবই দরকার। এরকম ধারণা থেকে জীবিত মানুষের কাছে যা কিছু অত্যাবশ্যকীয় সবই কবরের মধ্যে দিয়ে দেওয়া হত।
মিশরীয় সভ্যতা বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতা গুলির মধ্যে অন্যতম। মিশরীয়দের বিভিন্ন আবিষ্কার বিশ্বসভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে। কাগজের আবিষ্কার থেকে দিনরাত্রি, বছর গননা, পিরামিড থেকে স্ফিংস, চিত্রশিল্প থেকে কারুশিল্প কোন ক্ষেত্রটিতে মিশর অবদান রাখেনি সেটা খুঁজে বের করাই একটা বড়সড় চ্যালেঞ্জ। কিভাবেই বা এত প্রাচীনকালে তারা এত উন্নত নগর সভ্যতার সাথে পরিচিত হয়েছিল সেটা আজও অনুসন্ধান সাপেক্ষ। মিশরীয়দের জ্ঞান ও দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্দ সূক্ষ্ম চেতনার বিকাশ নিঃসন্দেহে উচ্চতর প্রশংসার দাবি রেখে যায়।