কাশ্মীর ভ্রমন (Kashmir)। কাশ্মীরের এতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা লোককথা অনুযায়ী কাশ্মীর মানে হল-শুষ্ক ভূমি।অনেকগুলো নামেই পরিচিত কাশ্মীর যেমন ঋষি ভূমি, সারদাপীঠ, সারদা ভূমি।তবে কাওয়ালী গানের জনক বিখ্যাত সুফি আমীর খসরু মন্তব্য করেছিলেন পৃথিবীতে যদি কোথায়ও বেহেশত থেকে থাকে তা হল কাশ্মীর। পৃথিবীর স্বর্গ কাশ্মীর আসলে জ্বলন্ত এক আগ্নেয়গিরির নাম। ২২২২৩৬ বর্গকিলোমিটার কাশ্মীর বিভক্ত হয়ে তিনটি ভাগে এর মধ্যে ৬০ ভাগ ভারতের, ৩০ ভাগ পাকিস্তানের এবং ১০ ভাগ চীনের অধীনস্থ। ভারতের অধীনস্থ অংশকে শ্রীনগর, জম্মু ও লাদাখ, পাকিস্তান শাসিত গিলগিট কাশ্মীর এবং আজাদ কাশ্মীর, চীন শাসিত আক্সাই চীন। তবে কাশ্মীরকে মোটামুটি দুটি ভাবেই আমরা চিনি একটি হচ্ছে পাকিস্তান শাসিত আজাদী কাশ্মীর আরেকটি ভারত-শাসিত জম্মু-কাশ্মীর। তার মধ্যে শ্রীনগর ও লাদাখ অঞ্চল নিয়েই ভারতকে সব সময় ব্যতিব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। কারণ এ অঞ্চলেই স্বাধীনতাকামীদের তৎপরতা বেশি। কাশ্মীরি মুসলমানদের কেউই ভারতীয় হিসেবে থাকতে চান না। আর তাই তারা নিজেদের ইন্ডিয়ান ভাবেন না। শুধু সেনাবাহিনী দিয়েই এলাকাটিকে ভারত করে রাখা হয়েছে। অন্যথায় কাশ্মীরিরা বলেন, তারা স্বতন্ত্র জাতি। বিগত ৭১ বছর ধরে তারা এ দাবিই করে আসছে কিন্তু এ দাবিকে কেউই পাত্তা দিচ্ছে না।
চোখ ধাধানো কাশ্মীরের সৌন্দর্য্য, সংস্কৃতির খ্যাতি সারা পৃথিবী জুড়ে। পর্যটকদের প্রধান আকর্ষন থাকে শ্রীনগর,পেহেলগাও,গুলমার্, শোনা মর্গ ও কাটারা। এছাড়াও ডালহৌসি, অমৃতসর,মানালি,কুল্লু, হিমাচল ও পাঞ্জাব সৌন্দার্যে্ কোন অংশেই কম নয়। পুরো কাশ্মীরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে যথেষ্ট সময় দরকার।কাশ্মীরের বন ঢেকে আছে পপলার উইলগাছ আর সবুজ শস্য ক্ষেতে।পুরো কাশ্মীর ঘিরে আছে পাহাড় মাইলের পর মাইল সবুজের সমভূম, লেক উপত্যাকা,আর পাহাড়ি ঝরনা । কাশ্মীরের আবহাওয়া কাশ্মীরের সৌন্দর্য আর কাশ্মীরের সংস্কৃতি সবকিছু মিলিয়ে কাশ্মীর যেন এক স্বর্গ ভূমি। পিরপাঞ্জাল গিরিশৃঙ্গ,কারাকোরাম নাঙ্গার আড়ালে থাকা কাশ্মীর যেন রং তুলিতে আকা একটি রুপকথার দেশ। রংবেরঙের পপি ফুল পর্যটকদের বাড়তি আকর্ষণ করে। ঝিলাম নদী,ডাল লেক, বাহারী ফুলের বাগান, বরফের পাহাড় এসব মিলিয়েই যেন কাশ্মীরের ঐতিহ্য।কাশ্মীরের আবহাওয়া সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে ষোল শতকে সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নুরজাহানের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন শালিমার গার্ডেন। সংস্কৃত ভাষায় শালিমার বাংলা অর্থ প্রেমের আভাস।
২০০৫ সালে একটি বড় ভূমিকম্পে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ নিহত হয় লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, যার ফলে এই অঞ্চলের অবকাঠামো এবং অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়ে যায়।
পীর পাঞ্জাল রেঞ্জ, নীলম, মূল নিবন্ধ: শারদা পীঠ, আরং কেল
শরদা পীঠ ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান মন্দির বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। বিশেষ করে এর গ্রন্থাগারের জন্য পরিচিত, এটি বৌদ্ধ পণ্ডিতদের সাথে যুক্ত ছিল যেমন কুমারাজীব, থোনমি সম্ভোতা, রিঞ্চেন জাংপো, সেইসাথে কালহানা পণ্ডিত এবং আদি শঙ্কর। এটি উত্তর ভারতে শারদা
সংস্কৃতি
যেহেতু ভারত, পাকিস্তান আর চীন নিয়েই কাশ্মীর তাই এখানকার সংস্কৃতি একাধিক রীতিনীতির মিশ্রণ । মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং শিখ এ সকল জাতি একত্রিত হয়ে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি পালন করে যা কাশ্মীরকে আরও আকর্ষনীয় করে তুলেছে। তাদের এ মিশ্র সংস্কৃতি তাদের জীবনযাত্রায় এনেছে পরিবর্তন ।
মূলত কাশ্মীরের সংস্কৃতি মধ্য এশীয় সংস্কৃতি এবং পারস্য সংস্কৃতি দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত। তাদের নৃত্য, সঙ্গীত, রান্না, কার্পেট বুনন এবং কোশুর সুফিয়ানা কাশ্মীরি পরিচয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। ঐতিহ্যবাহী নৌকা এবং হাউসবোট, হস্তশিল্প এবং কবিতা সহ চারুকলার জন্য কাশ্মীর বিশ্বজোড়া পরিচিত।
খাবার
আমিষ এবং নিরামিষ উভয় খাবারেই কাশ্মীর প্রসিদ্ধ। কাশ্মীরি কেবাগ, মাটন দিয়ে তৈরী রোগান জোশ, ইয়াখনি, পাসন্দা, সায়ুন আলু এবং মেথি কিমা এগুলো কাশ্মিরের জনপ্রিয় তবে নিরামীষ ভোজীদের রয়েছে কিছু বিখ্যাত খাবার যার মধ্যে রয়েছে হাক, রাজমাহ, জর্দা, তুর্শ, শ্রী পুলাও, নাদির ইয়াখেন এবং লেডিয়ার তাসমান। খাবারের একটি আকর্ষণীয় স্বাদ দিতে এই খাবারগুলি পনিরের সাথে তাজা সবজি দিয়ে প্রস্তুত করা হয়।
আপনি যদি ডেজার্ট প্রেমী হন তবে আপনাকে অবশ্যই সেবাইয়ান, ফিরনি এবং বরফি খেতে হবে। এ খাবার আপনাকে মিষ্টির প্রেমে ফেলবেই। কাশ্মীরে অতিথিদের গরম গরম চা এবং কাহওয়া দিয়ে স্বাগত জানানো হয় যা আপনি আগে কখনও স্বাদ করেননি। কাশ্মীরি পুলাও বিশ্বব্যাপী একটি বিখ্যাত খাবার যা প্রায় প্রতিটি বাড়িতে নিয়মিত বিরতিতে প্রস্তুত করা হয়। বিপুল সংখ্যক কাশ্মীরি জনগোষ্ঠী হাক বা করম সাগ পছন্দ করে যা বেশিরভাগই শীতের সময় ঠান্ডা আবহাওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য তৈরি করা হয়।
পোশাক
কাশ্মীরি মানুষের পোশাক খুবই রঙিন এবং আকর্ষণীয়। তবে কমসংখ্যক মানুষই তিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে। নারীরা নিজেদেরকে নাকের আংটি, চুড়ি, কানে বড় দুল, গলায় বড় হাড় পড়তে পছন্দ করে। পেশাক হিসেবে নারীরা সালোয়ার কামিজ বেশি পড়ে থাকেন। পুরুষরা নিজেদের কুর্তা পায়জামা, শালওয়ার, গরবি এবং স্কালক্যাপ পরিধান করে। শীতকালে কাশ্মীরি মানুষ বিশেষ একধরনের ওভারকোট পরে যা রঙিন সুতার সুক্ষ সূচিকর্ম দিয়ে তৈরী।
তবে কাশ্মীরিদের বেশিরভাগ পোশাকই হয় লালা গাউন এবং আবহাওয়া অনুযায়ী কাপড়ের তারতম্য হয়। বেশির ভাগ পুরুষই মাথায় কাপড় পরে এবং মহিলারা স্কালক্যাপ পরে। কাশ্মীরি পোশাক সত্যিই তাদের সংস্কৃতি এবং জীবনধারা নির্দেশ করে। কাশ্মীর তাদের পোশাক দিয়ে নিজেস্ব সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রমান দেয় ।
উৎসব:
কাশ্মীরি জনগণ নানান রকমের উৎসব উৎযাপন করেন।কাশ্মীরি উৎসব ওদের ঐতিয্যেরই একটা অংশ।ওদের উৎসবের মধ্যে বৈশাখী, লোহরি, ইদ-উল-দুল ফিতর, ইদ-উল-আযহা হেমিস উৎসব, টিউলিপ উৎসব, শিকার উৎসব, গুরেজ উৎসব, সিন্দু দর্শন এবং ডোমোচে বেশ উল্লেখযোগ্য। উৎসবের মসুমে বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়ো হয় এবং প্রচুর উৎসাহের সাথে এই শুভ দিনগুলি উপভোগ করে।
ঔতিহ্যবাহী নৃত্য, চিত্রকলায় অংশগ্রহণ, বহু-রন্ধনশিল্প এবং হস্তশিল্পের দোকান এই উৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাশ্মীরের লোকজন নানান রকম মেলারও আয়োজন করে যেমন বহু মেলা, ঝিরি মেলা এবং ক্রাফট মেলা ইত্যাদি আর এগুলোর মাধ্যমেই ওদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। কাশ্মীর পৃথিবীর অন্যতম সেরা জায়গা যেখানে আপনি একই সাথে উপোভোগ করতে পারবেন সমৃদ্ধশালী ঐতিয্য এবং সংস্কৃতির সেই সাথে এর সৌন্দর্য।
হস্তশিল্পের
কাশ্মীর বিশ্বমানের হস্তশিল্পের জন্য বিখ্যাত। কাশ্মীরের পশমি শালের কদর বিশ্বব্যাপী । শালের নকশা এবং সূচিকর্মের কাজ এতই নিখুত যা রাজকীয়তার প্রতীক বহন করে। উষ্ণতা, স্নিগ্ধতা আর শ্বসরুদ্ধকর নকশা কাশ্মীরী শালের প্রধান বৈশিস্ট। তাদের হাতে গড়া কার্পেট, পশমের নকশা এবং পুষ্পের নকশার জন্যও কাশ্মীর বিখ্যাত।
এছাড়াও বাস্কেটরি, কাগজের নকশা, আখরোটের কাঠ এবং কাঠের খোদাই করা আসবাবপত্র কাশ্মীরিদের দেওয়া সেরা হস্তশিল্প। যেহেতু কাশ্মীর পর্যটকদের জন্য অন্যতম সেরা আকর্ষণ, তাই ক্রমেই তাদের হস্তশিল্প শিল্পের প্রসার ঘটছে।
নৃত্য ও সঙ্গীত
কাশ্মীরের নৃত্য এবং সঙ্গীতের রয়েছে নিজস্ব শৈলী । প্রায় প্রতিটি উৎসবে, মেলায় নাচ এবং সঙ্গীতের আয়োজন থাকে যা পর্যটকদের জন্যও একটি বড় আকর্ষণ। উপলক্ষ অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের নৃত্য ও সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। জনপ্রিয় নৃত্যের একটি হল মাস্ক নৃত্য যা হেমিস উৎসবের সময় পরিবেশন করা হয়। নৃত্যশিল্পীরা রঙিন পোশাক পরে, মুখোশ এবং ব্রোকেডের পোশাক পরে এবং আনুষ্ঠানিক নৃত্য করে। অন্যান্য প্রধান নাচের ধরন হল চাকরি, লাদিশাহ, রুফ নৃত্য এবং ডান্ডারস নৃত্য। রাউল, ডোগরি এবং উয়েগি-নাচুন লোক নৃত্যের কিছু রূপ।
কাশ্মীরিরা লোকসংগীত পছন্দ করে এবং সবচেয়ে বিখ্যাত রাবাব সঙ্গীতে তাদের রয়েছে দক্ষতা। এই সঙ্গীতে বাজানো সাধারণ যন্ত্র হল সেতার, দুকড়া এবং নাগারা। কাশ্মীরে ওয়ানাউন, গজল, সুফি এবং কোরাল কিছু প্রধান সঙ্গীতে ধরন রয়েছে যা বিবাহের অনুষ্ঠান এবং উৎসবের সময় গাওয়া হয়।
পেশা
কাশ্মীরের পেশা প্রধানত কৃষি কাজ। প্রধান কৃষিপন্যের মধ্যে রয়েছে ভাত, ভুট্টা, সরিষা, তুলা বীজ, মূলা, পেঁয়াজ, করলা, পদ্ম-ডাল, তিসি, গাজর ইত্যাদি। , আঙ্গুর, বরই, আপেল, চেরি, এপ্রিকট, আখরোট, বাদাম ইত্যাদি কৃষিপণ্য রপ্তানি এবং হস্তশিল্প, শাল এবং পাটি রপ্তানি করে কাশ্মীর প্রচুর বৈদেশীক মুদ্রা অর্জন করে।