এন্টার্কটিকা মহাদেশ……… বিশ্বভ্রমন্ডের যে জায়গায় সম্পূর্ন ভিন্ন রূপ দেখা যায় সেটিই হচ্ছে এন্টার্কটিকা মহাদেশ। এ যেন চেনা পৃথিবীর অচেনা রূপ। পৃথিবীর সর্ব দক্ষিনে অবস্থিত এ মহাদেশটির আয়তন ১,৪২,০০,০০০ বর্গকিলোমিটার । এন্টর্কটিকা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম মহাদেশ এবং আয়তনে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের প্রায় দ্বিগুণ। তবে এ মহাদেশটি পৃথিবীর সর্বনিম্ন জনবসতিপূর্ণ মহাদেশ। এন্টর্কটিকা মহদেশের ৯৮% অঞ্চলই পুরু বরফে আবৃত। এন্টর্কটিকার উত্তরপ্রন্তের কিছু অংশ বাদে পুরো মহাদেশটাই বরফে আবৃত।
পৃথিবীর দুর্গমতম এবং উচ্চতম মহাদেশ এন্টার্কটিকা। এন্টার্কটিকা যেমন শীতলতম জায়গা তেমনি নির্জনতম মহাদেশ ও বটে। এখানেই দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাতাস চলাচল করলেও এ মহাদেশ সবচেয়ে শুষ্কতম । এন্টার্কটিকার গড় তাপমাত্রা -৮৯.২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেট মাঝে মাঝে এই তাপমাত্রা -৯৭.৭ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেট পর্যন্ত নেমে যায়। অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের কোন স্থায়ি অধিবাসী নেই এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্য্যন্ত কোন মানুষ এই স্থানকে দেখেছিলেন বলে কোন প্রমাণ নেই। তবে এখন সারা মহাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গবেষনা কেন্দ্রগুলোতে সারা বছরে ১০০০ থেকে ৫০০০ লোক বসবাস করে। এখানকার স্থানীয় জীবজগতের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শৈবাল, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, উদ্ভিদ ইত্যাদি এছাড়াও রয়েছে মাইট, নেমাটোডা, পেঙ্গুইন, সিল , টারডিগ্রেড ও বিভিন্ন ধরনের প্রাণী। এন্টার্কটিকায় আকর্ষনীয় প্রনীদের মধ্যে রয়েছে পেঙ্গুইন। শুভ্র রবফের এ মহাদেশে তুন্দ্রা অঞ্চলেই কিছু গাছপালা দেখা যায়।
বিশ্ব ইতিহাসে এন্টার্কটিকা সর্বশেষ আবিষ্কৃত অঞ্চল।আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ অব্দ নাগাদ অ্যারিস্টটল তাঁর মেতেওরোলজিকা গ্রন্থে একটি অ্যান্টার্কটিক অঞ্চল-এর কথা উল্লেখ করেন । কথিত আছে, খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে তিরের মারিনোস তাঁর অসংরক্ষিত বিশ্ব মানচিত্রে এই নামটি ব্যবহার করেছিলেন। ১৮৯০-এর দশকে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে একটি মহাদেশের নাম হিসাবে “অ্যান্টার্কটিকা শব্দটি ব্যবহৃত হয় । স্কটিশ মানচিত্রাঙ্কনবিদ জন জর্জ বার্থেলোমিউকে এই নামকরণের হোতা বলে মনে করা হয় । ১৮৯৫ সালে নরওয়েজীয় অভিযাত্রীদের একটি দলই প্রথম এই মহাদেশে অবতরণ করে বলে নিশ্চিতভাবে জানা যায়।
১) এন্টার্কটিকায় কাজ করতে গেলে শরীর থেকে বাদ দিতে হবে আক্কেল দাঁত ও অ্যাপেনডিক্স। এই মহাদেশে শল্যচিকিত্সার ব্যবস্থা নেই। সুতরাং এখানে আসার আগেই ওই দু’টির মায়া কাটিয়ে আসতে হবে।
২) বিশ্বের শুষ্কতম স্থান এন্টার্কটিকা। এই মহাদেশের ড্রাই ভ্যালি অঞ্চল পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে শুকনো এলাকা বলে চিহ্নিত।
৩) বেশ কিছু দেশের মতো (যেমন অস্ট্রেলিয়ার .au বা জার্মানির .de অথবা ভারতের .in) আন্টার্কটিকারও নিজস্ব ডোমেইন রয়েছে। তুষার রাজ্যের ডোমেইন হল .aq।
৪) ৫.৩ কোটি বছর আগে এন্টার্কটিকার আবহাওয়া যথেষ্ট উষ্ণ ছিল। সেই সময় এখানকার গড় তাপমান ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখানে সমুদ্রের তীর বরাবর পাম গাছের সারি দেখা যেত।
৫) বিশ্বখ্যাত মার্কিন হেভি মেটাল রকব্যান্ড মেট্যালিকা এন্টার্কটিকায় পারফর্ম করেছিল। তাদের জনপ্রিয় গান Freeze ‘Em All-এর শ্যুটিং হয়েছিল চিরতুষারের দেশে। উল্লেখ্য, মাত্র এক বছরে বিশ্বের সাতটি মহাদেশে অনুষ্ঠান করে নজির গড়ে মেট্যালিকা।
৬) এন্টার্কটিকাতেও রয়েছে পরমাণু চুল্লি। ১৯৬২ সাল থেকে এই মহাদেশের বুকে কাজ করে চলেছে মার্কিন পরমাণু চুল্লি ম্যাকমার্ডো স্টেশন।
৭) এন্টার্কটিকার নিজস্ব দমকল বিভাগ রয়েছে। ম্যাকমার্ডো স্টেশনের ভিতরেই রয়েছে এই দপ্তর। আগুন নেভাতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং পেশাদার দমকলকর্মীরা এখানে মজুত।
৮) চরম আবহাওয়া থাকা সত্বেও আন্টার্কটিকায় পাওয়া যায় ১১৫০ প্রজাতির ছত্রাক। এদের মধ্যে বেশ কিছু প্রজাতি রীতিমতো নজরকাড়া। আসলে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আবহাওয়াতেও নিজেদের অনায়াসে খাপ খাইয়ে নিতে পারে ছত্রাক।
৯) বিশ্বের প্রতিটি টাইমজোন পাওয়া যায় এন্টার্কটিকায়। পৃথিবীর দুই মেরুতে এসে মিলেছে সময় বিভাজনকারী দ্রাঘিমা রেখা। স্বাভাবিক ভাবেই এখানে রয়েছে দুনিয়ার সমস্ত টাইমজোনের উপস্থিতি।
১০) চায়নায় যেমন হায়না মেলে না তেমনই আএন্টার্কটিকায় পোলার বিয়ার অর্থাত্ মেরু-ভালুক বাস করে না। এদের বসতি আর্কটিক অঞ্চল অথবা কানাডায়।
১১) এন্টার্কটিকায় রয়েছে বিশ্বের দক্ষিণতম পানশালাটি। শীতলতম অবস্থানে একটু উষ্ণ হতে চাইলে ভার্নার্ডস্কাই গবেষণা কেন্দ্র লাগোয়া এই বার-ই ভরসা।
১২) পৃথিবীর বুকে শীতলতম তাপমাত্রা নথিভুক্ত হয়েছিল এন্টার্কটিকাতেই। ১৯৮৩ সালের ২১ জুলাই আন্টার্কটিকার ভস্তক স্টেশনে রেকর্ড হওয়া তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ১২৮.৫৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট অর্থাত্ মাইনাস ৮৯.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
১৩) এন্টার্কটিকা পৃথিবীর পঞ্চম বিশালতম মহাদেশ। এর মোট এলাকা ১.৪ কোটি বর্গ কিলোমিটার।
১৪) এন্টার্কটিকার ১৪.৯৯ শতাংশ অঞ্চল বরফে মোড়া। একাধিক হিমবাহের নীচে চাপা পড়েছে মহাদেশের জমি। তুষারের এই স্তরকে বলা হয় বরফ চাদর।
১৫) এন্টার্কটিকার কঠিন বরফ চাদরের গড়ে প্রায় ১.৬ কিলোমিটার পুরু। পৃথিবীর মিষ্টি জল ভাণ্ডারের প্রায় ৭০ শতাংশই আন্টার্কটিকায় অবস্থিত।
১৬) এন্টার্কটিকার মাঝে রয়েছে ট্র্যান্সআন্টার্কটিক পর্বতশ্রেণী যা মহাদেশকে পূর্ব ও পশ্চিম অংশে ভাগ করেছে। কেপ অ্যাডেয়ার থেকে কোটসল্যান্ড পর্যন্ত এই পর্বতশ্রেণির মোট বিস্তৃতি ৩৫০০ কিলোমিটার।
১৭) ১৮২০ সালে আবিষ্কার হওয়ার আগে পর্যন্ত এন্টার্কটিকাকে দ্বীপপুঞ্জ হিসেবে মনে করা হত।
১৮) নরওয়ের বাসিন্দা রোয়াল্ড আমুন্ডসেন প্রথম মানুষ যিনি দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছেছিলেন। ব্রিটিশ অভিযাত্রী রবার্ট স্কটকে পিছনে ফেলে এই মহাদেশে তিনি পৌঁছান ১৯১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর।
১৯) ১৯৫৯ সালে ১২টি দেশ এন্টার্কটিকা চুক্তি সই করে। চুক্তি অনুসারে, এই মহাদেশকে শান্তিপূর্ণ গবেষণামূলক কাজের জন্য উত্সর্গ করা হয়। বর্তমানে মোট ৪৮টি দেশ এই চুক্তির শরিক।
২০) ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসে এন্টার্কটিকায় জন্মগ্রহণ করে প্রথম মানবশিশু এমিলিও মার্কো পামা। ঘটনা ঘিরে পরবর্তীকালে তৈরি হয় নানা বিতর্ক। অভিযোগ, তুষারভূমির একাংশ দখল করার উদ্দেশে জেনেশুনে এক সন্তানসম্ভবাকে এন্টার্কটিকায় পাঠিয়েছিল আর্জেন্টিনা।